📺 পর্ব – ৫: টেকনিক্যাল চেকআপ ও সার্ভিসিং: ধাপে ধাপে সমাধান
২৩. পাওয়ার সাপ্লাই সার্কিট টেস্ট ও রিপেয়ার
গুরুত্ব:
একটি টেলিভিশন চালু না হওয়ার প্রায় ৮০% কারণ হলো এর পাওয়ার সাপ্লাই সার্কিট নষ্ট হওয়া। এটিই টিভির প্রাণ, যা বাইরের AC বিদ্যুৎকে টিভির ভেতরের বিভিন্ন অংশের জন্য প্রয়োজনীয় DC ভোল্টেজে রূপান্তর করে।
টেস্টিং পদ্ধতি:
·
দৃষ্টিভঙ্গিগত
পরিদর্শন:
প্রথমে পাওয়ার সাপ্লাই বোর্ডটি খুলে ভালোভাবে দেখুন। কোনো পোড়া অংশ, কালো ছোপ, ফুলে যাওয়া ক্যাপাসিটর বা ক্ষতিগ্রস্ত রেজিস্টর আছে কি না তা লক্ষ্য করুন।
·
ইনপুট
ভোল্টেজ চেক: মাল্টিমিটার ব্যবহার করে প্রথমে বোর্ডের ইনপুট পিনে AC ভোল্টেজ (সাধারণত ২২০V) আসছে কি না তা পরীক্ষা করুন।
·
রেক্টিফায়ার
ও ক্যাপাসিটর টেস্ট: ইনপুট ভোল্টেজ ঠিক থাকলে রেক্টিফায়ার ডায়োড ও বড় ক্যাপাসিটরটি টেস্ট করুন। রেক্টিফায়ার AC কে DC-তে রূপান্তরিত করে, আর ক্যাপাসিটর ভোল্টেজকে মসৃণ করে। এই দুটি কম্পোনেন্ট নষ্ট হলে আউটপুট ভোল্টেজ সঠিক হবে না।
·
আউটপুট
ভোল্টেজ চেক: পাওয়ার সাপ্লাই থেকে মাদারবোর্ড বা অন্যান্য অংশে যাওয়ার জন্য যে আউটপুট পিনগুলো থাকে, সেখানে নির্দিষ্ট DC ভোল্টেজ (যেমন: ৫V, ১২V, ২৪V) আসছে কি না মাল্টিমিটার দিয়ে পরীক্ষা করুন। কোনো ভোল্টেজ না পেলে বা ভুল ভোল্টেজ পেলে পাওয়ার সাপ্লাই বোর্ডটি ত্রুটিপূর্ণ।
·
শর্ট
সার্কিট সনাক্তকরণ: বোর্ডে কোনো শর্ট সার্কিট থাকলে সেটি গরম হয়ে যায়। স্পর্শ করে বা ইনফ্রারেড থার্মোমিটার ব্যবহার করে গরম অংশ চিহ্নিত করুন।
রিপেয়ার:
·
ফিউজ
পরিবর্তন:
যদি ফিউজ পুড়ে যায়, তবে একই মানের নতুন ফিউজ লাগান। তবে ফিউজ কেন পুড়লো, সেই মূল কারণটি খুঁজে বের করা জরুরি।
·
ক্যাপাসিটর
রিপ্লেস:
ফুলে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাপাসিটরগুলো সরিয়ে একই মান ও ভোল্টেজের নতুন ক্যাপাসিটর লাগান। এটি পাওয়ার সাপ্লাই সার্কিট রিপেয়ারের সবচেয়ে সাধারণ কাজ।
·
পাওয়ার
আইসি (IC) পরিবর্তন: যদি ভোল্টেজ রেগুলেটর বা পাওয়ার আইসি নষ্ট হয়ে যায়, তবে সেটি সোল্ডার করে নতুন আইসি লাগাতে হবে। এটি একটি সূক্ষ্ম কাজ, যার জন্য সোল্ডারিং স্টেশন ও হট এয়ার গান প্রয়োজন।
২৪. ব্যাকলাইট LED চেক ও রিপ্লেসমেন্ট
গুরুত্ব:
এলইডি টিভির সাউন্ড আছে কিন্তু ছবি নেই—এই সমস্যার প্রায় ৯০% কারণ হলো ব্যাকলাইট নষ্ট হয়ে যাওয়া।
চেক করার পদ্ধতি:
·
LED টেস্টার
ব্যবহার:
একটি ডেডিকেটেড LED টেস্টার ব্যবহার করে প্রতিটি LED স্ট্রিপ বা এমনকি আলাদা আলাদা LED বাতি পরীক্ষা করুন। এটি প্রতিটি বাতিকে আলাদাভাবে আলোকিত করে তার কার্যকারিতা যাচাই করে।
·
দৃষ্টিভঙ্গিগত
পরীক্ষা:
ব্যাকলাইট স্ট্রিপে কোনো LED বাতি পুড়ে গেছে কি না, তা দৃশ্যত দেখুন। পুড়ে যাওয়া বাতিগুলো সাধারণত কালো ছোপ যুক্ত হয়।
রিপ্লেসমেন্ট:
·
টিভি
খোলা: ব্যাকলাইট পরিবর্তন করতে হলে টিভির ডিসপ্লে প্যানেল সাবধানে খুলে আলাদা করে রাখতে হয়। এই কাজটি খুব সতর্কতার সাথে করতে হয়, অন্যথায় ডিসপ্লে ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
·
নষ্ট
স্ট্রিপ বা LED পরিবর্তন: পুড়ে যাওয়া LED স্ট্রিপটি চিহ্নিত করে সেটিকে পুরোপুরি পরিবর্তন করুন। একটি স্ট্রিপের একটি LED নষ্ট হলেও পুরো স্ট্রিপটি পরিবর্তন করা উচিত, কারণ এটি ভবিষ্যতে অন্যান্য LED নষ্ট হওয়া রোধ করে।
·
ড্রাইভার
সার্কিট পরীক্ষা: নতুন স্ট্রিপ লাগানোর আগে ব্যাকলাইটের ড্রাইভার সার্কিটটি সঠিকভাবে ভোল্টেজ সরবরাহ করছে কি না তা পরীক্ষা করুন। যদি ড্রাইভার বোর্ড নষ্ট থাকে, তবে নতুন স্ট্রিপও জ্বলবে না।
২৫. ডিসপ্লে প্যানেল সমস্যা চিহ্নিত করা
গুরুত্ব:
ডিসপ্লে প্যানেল হলো টিভির সবচেয়ে ব্যয়বহুল অংশ। তাই এর সমস্যা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা জরুরি।
চেক করার পদ্ধতি:
·
T-CON বোর্ড
ও LVDS কেবল: মাদারবোর্ড থেকে T-CON (Timing
Controller) বোর্ডে
আসা LVDS/ফ্লেক্স কেবল ঢিলা আছে কি না তা পরীক্ষা করুন। অনেক সময় কেবলটি ঢিলা থাকলে স্ক্রিনে লাইন, ঝিরঝির বা ভুল রঙ দেখা যায়।
·
অন্যান্য
ডিসপ্লে পরীক্ষা: যদি সম্ভব হয়, T-CON বোর্ডটি অন্য কোনো একই মডেলের টিভির ডিসপ্লের সাথে সংযুক্ত করে দেখুন। যদি সেখানেও একই সমস্যা হয়, তবে T-CON বোর্ডটিই ত্রুটিপূর্ণ।
·
দৃশ্যত
পরিদর্শন:
প্যানেলে কোনো ফিজিক্যাল ড্যামেজ, যেমন - ফাটল বা চাপজনিত দাগ আছে কি না তা দেখুন। টিভি স্ক্রিনে লাইন বা স্পট সাধারণত প্যানেলের ভেতরের ক্ষতির কারণে হয়।
সমাধান:
·
কেবল
ঠিক করুন: যদি কেবল লুজ থাকে, তবে সেটি সঠিকভাবে সংযুক্ত করুন।
·
T-CON বোর্ড
রিপ্লেস:
যদি T-CON বোর্ডটি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে এটি পরিবর্তন করুন।
·
প্যানেল
পরিবর্তন:
যদি ডিসপ্লে প্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে এটি রিপেয়ার করা সাধারণত সম্ভব হয় না। এই ক্ষেত্রে পুরো প্যানেলটি পরিবর্তন করতে হয়, যা আর্থিক দিক থেকে লাভজনক না-ও হতে পারে।
২৬. মাদারবোর্ড মেরামত
গুরুত্ব:
টিভি মাদারবোর্ড মেরামত একটি জটিল কাজ, কারণ এটি টিভির সমস্ত ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে।
মেরামতের ধাপ:
·
আইসি
ও ক্যাপাসিটর চেক: মাদারবোর্ডে কোনো আইসি বা প্রসেসর অতিরিক্ত গরম হচ্ছে কি না দেখুন। ফুলে যাওয়া বা লিকেজ করা ক্যাপাসিটরগুলোও পরিবর্তন করুন।
·
সোল্ডার
জয়েন্ট পরীক্ষা: আইসি, কানেক্টর ও অন্যান্য কম্পোনেন্টের সোল্ডার জয়েন্টগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখুন। অনেক সময় অতিরিক্ত উত্তাপ বা সময় পার হলে সোল্ডারগুলো দুর্বল হয়ে যায়। প্রয়োজন হলে পুনরায় সোল্ডার করুন।
·
পোর্টস
পরীক্ষা:
HDMI/USB/AV পোর্ট
সমস্যা
হলে মাদারবোর্ডের সাথে তাদের সোল্ডার জয়েন্ট এবং ভেতরের সার্কিট পরীক্ষা করুন।
২৭. টিউনার ও স্পিকার সার্ভিসিং
গুরুত্ব:
টেলিভিশন থেকে সঠিক ছবি ও শব্দ পেতে টিউনার এবং স্পিকারের কার্যকারিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
·
টিউনার
সার্ভিসিং:
o
ভোল্টেজ
চেক: টিউনারে প্রয়োজনীয় ভোল্টেজ আসছে কি না মাল্টিমিটার দিয়ে পরীক্ষা করুন।
o
সোল্ডার
জয়েন্ট:
টিউনারের পিনগুলো মাদারবোর্ডে ভালোভাবে সোল্ডারিং করা আছে কি না তা পরীক্ষা করুন।
·
স্পিকার
সার্ভিসিং:
o
কয়েল
চেক: স্পিকারের কয়েল পুড়ে গেলে সাউন্ড আসবে না। মাল্টিমিটার ব্যবহার করে স্পিকারের রেজিস্ট্যান্স চেক করুন। সঠিক রেজিস্ট্যান্স না পেলে স্পিকারটি নষ্ট।
o
নতুন
স্পিকার:
স্পিকার কয়েল বার্ন হয়ে গেলে তা পরিবর্তন করতে হবে।
২৮. সফটওয়্যার রি-ইনস্টলেশন / আপগ্রেড
গুরুত্ব:
স্মার্ট টিভিতে সফটওয়্যার সমস্যা হলে তা টিভি হ্যাং হওয়া, বারবার রিস্টার্ট হওয়া বা অ্যাপ কাজ না করার মতো সমস্যা তৈরি করে।
প্রক্রিয়া:
·
সঠিক
ফার্মওয়্যার
ডাউনলোড:
প্রথমে টিভির মডেল নম্বর ও ব্র্যান্ড নিশ্চিত করুন। এরপর সেই কোম্পানির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে সঠিক ফার্মওয়্যার ডাউনলোড করুন। ভুল ফার্মওয়্যার ব্যবহার করলে টিভি স্থায়ীভাবে নষ্ট হতে পারে।
·
USB প্রস্তুতি:
একটি পরিষ্কার USB ড্রাইভে ফার্মওয়্যার ফাইলটি কপি করুন। ফাইলটি সাধারণত .zip, .bin বা .img ফরম্যাটে থাকে।
·
ইনস্টলেশন:
USB ড্রাইভটি টিভিতে প্রবেশ করিয়ে টিভির সেটিংস থেকে আপডেট অপশনটি খুঁজে বের করুন। কিছু টিভিতে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট হয়। আপডেট চলাকালীন কোনোভাবেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।
সারসংক্ষেপ
টেলিভিশন টেকনিক্যাল চেকআপ এবং সার্ভিসিং একটি জটিল প্রক্রিয়া হলেও সঠিক টুলস, জ্ঞান এবং ধৈর্য থাকলে যেকোনো সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। পাওয়ার সাপ্লাই, ব্যাকলাইট, ডিসপ্লে, মাদারবোর্ড, টিউনার, স্পিকার এবং সফটওয়্যার—এই প্রতিটি অংশের স্বতন্ত্র গুরুত্ব আছে। সঠিকভাবে এই সব অংশের পরীক্ষা এবং মেরামত করা গেলে শুধুমাত্র টিভির আয়ুষ্কালই বাড়ে না, বরং একজন টেকনিশিয়ান হিসেবে আপনার দক্ষতা ও খ্যাতিও বৃদ্ধি পায়।

কোন মন্তব্য নেই