Cathode Ray Tube (CRT): ডিসপ্লে প্রযুক্তির এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন

 

Cathode Ray Tube (CRT): ডিসপ্লে প্রযুক্তির এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন

Cathode Ray Tube (CRT) একসময়কার ডিসপ্লে প্রযুক্তির প্রধান ভিত্তি ছিল, যা টেলিভিশন, কম্পিউটার মনিটর এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিতে বহুল ব্যবহৃত হতো। আজকের এলসিডি, এলইডি বা ওএলইডি স্ক্রিনগুলো CRT-এর চেয়ে অনেক উন্নত হলেও, আধুনিক ডিসপ্লে প্রযুক্তির ধারণাগত ভিত্তি তৈরি হয়েছে CRT থেকেই। ১৯ শতকের শেষের দিকে জার্মানির পদার্থবিদ কার্ল ফার্দিনান্ড ব্রাউন (Karl Ferdinand Braun) প্রথম CRT-এর প্রাথমিক রূপটি তৈরি করেন। এটি ছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ব্যবহৃত একটি যন্ত্র, যা পরে ইলেকট্রনিক ডিসপ্লেতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।


CRT কী এবং এর মূল উপাদানগুলো

CRT হলো একটি Vacuum Tube বা শূন্য নল, যার মধ্যে ইলেকট্রন উৎপন্ন হয় এবং অত্যন্ত দ্রুতগতিতে একটি স্ক্রিনের দিকে প্রবাহিত হয়। স্ক্রিনের ভেতরের পৃষ্ঠে ফসফর নামক একটি বিশেষ পদার্থের প্রলেপ থাকে। যখন ইলেকট্রন এই ফসফর প্রলেপে আঘাত করে, তখন তা জ্বলে ওঠে এবং আলো তৈরি করে। এই আলোর উজ্জ্বল বিন্দুগুলো একত্রিত হয়েই আমাদের চোখের সামনে ছবি, লেখা বা ভিডিও রূপে দৃশ্যমান হয়। এক কথায়, CRT হলো এমন একটি টিউব যা ইলেকট্রনের প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে দৃশ্যমান ছবি তৈরি করে

একটি CRT-এর প্রধান অংশগুলো হলো:

  1. Electron Gun (ইলেকট্রন গান): এটি CRT-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মূল কাজ হলো একটি ধারাবাহিক ইলেকট্রন বিম তৈরি করা। একটি উত্তপ্ত ক্যাথোড থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়, যা একটি উচ্চ ভোল্টেজের মাধ্যমে দ্রুতগতিতে স্ক্রিনের দিকে চালিত হয়।

  2. Control Grid (কন্ট্রোল গ্রিড): এটি ইলেকট্রন গানের ঠিক সামনে থাকে এবং ইলেকট্রনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এর মাধ্যমে ইলেকট্রন বিমের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যার ফলে স্ক্রিনের আলোর উজ্জ্বলতা কমানো বা বাড়ানো যায়।

  3. Deflection System (ডিফ্লেকশন সিস্টেম): এই অংশটি ইলেকট্রন বিমের গতিপথ পরিবর্তন করে। এটি সাধারণত দুটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক কয়েল বা প্লেট দিয়ে গঠিত।

    • Horizontal Deflection: ইলেকট্রনকে ডানে-বামে সরায়।

    • Vertical Deflection: ইলেকট্রনকে উপরে-নিচে সরায়। এই দুটি কয়েল বা প্লেটের সমন্বয়ে ইলেকট্রন বিমকে স্ক্রিনের যেকোনো নির্দিষ্ট বিন্দুতে পাঠানো সম্ভব হয়।

  4. Phosphor-coated Screen (ফসফর প্রলেপযুক্ত স্ক্রিন): এটি CRT-এর সামনের অংশ, যা মূলত একটি কাচের পর্দা। এর ভেতরের পৃষ্ঠে ফসফর নামক পদার্থের প্রলেপ থাকে। রঙিন CRT-এর ক্ষেত্রে, এই প্রলেপটি তিনটি ভিন্ন রঙের (লাল, সবুজ, ও নীল) ফসফরের বিন্দু দিয়ে তৈরি হয়। প্রতিটি বিন্দু একটি করে পিক্সেল তৈরি করে।


CRT-এর কাজের প্রক্রিয়া

CRT-এর কার্যপ্রণালী একটি নির্দিষ্ট ধাপে সম্পন্ন হয়:

  1. ইলেকট্রন তৈরি: ইলেকট্রন গান থেকে একটি উত্তপ্ত ফিলামেন্ট থেকে ইলেকট্রন বের হয়।

  2. ইলেকট্রন নিয়ন্ত্রণ: কন্ট্রোল গ্রিড এই ইলেকট্রনগুলোকে একটি সরু বিমে পরিণত করে এবং এর তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করে, যা ছবির উজ্জ্বলতা নির্ধারণ করে।

  3. গতিপথ পরিবর্তন: ডিফ্লেকশন কয়েল বা প্লেটগুলো ইলেকট্রন বিমকে নির্দিষ্ট কোণে বাঁকিয়ে দেয়, যাতে এটি স্ক্রিনের বিভিন্ন বিন্দুতে পৌঁছাতে পারে।

  4. ছবি তৈরি: যখন ইলেকট্রন বিম ফসফর প্রলেপযুক্ত স্ক্রিনে আঘাত করে, তখন ফসফর জ্বলে ওঠে এবং আলো তৈরি হয়। এই আলোর ভিন্ন ভিন্ন উজ্জ্বলতা ও রঙের বিন্দুগুলো মিলে সম্পূর্ণ ছবিটি তৈরি হয়।

এই পুরো প্রক্রিয়াটি প্রতি সেকেন্ডে অনেকবার (সাধারণত ৬০ থেকে ১০০ বার) পুনরাবৃত্তি হয়, যাকে রিফ্রেশ রেট বলা হয়। এর ফলে আমাদের চোখে একটি মসৃণ ও নিরবচ্ছিন্ন ছবি ধরা পড়ে।


CRT-এর ব্যবহার ও এর বিবর্তন

CRT প্রযুক্তি তার সময়ে ইলেকট্রনিক্স শিল্পে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। এর প্রধান ব্যবহারগুলো ছিল:

  1. টেলিভিশন: সাদা-কালো এবং রঙিন উভয় ধরনের পুরনো টেলিভিশন সেটে CRT প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতো।

  2. কম্পিউটার মনিটর: ১৯৯০ এবং ২০০০ সালের শুরুর দিকে কম্পিউটার মনিটরের ক্ষেত্রে CRT ছিল একমাত্র ভরসা।

  3. অসিলোস্কোপ: বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সার্কিট বিশ্লেষণ এবং বৈদ্যুতিক তরঙ্গ দেখার জন্য ব্যবহৃত অসিলোস্কোপ যন্ত্রগুলোতে CRT-এর ব্যবহার ছিল অপরিহার্য।

  4. ভিডিও গেম কনসোল: Nintendo Entertainment System (NES) বা Atari-এর মতো পুরনো গেম কনসোলগুলো CRT স্ক্রিনেই তাদের সেরা পারফরম্যান্স দিত।

  5. রাডার: সামরিক ও বিমান চলাচলের রাডার ডিসপ্লেতেও CRT প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো।

CRT প্রযুক্তি কয়েক দশক ধরে রাজত্ব করলেও, এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এর আকার ও ওজন ছিল অনেক বেশি, যা একে সহজে বহনযোগ্য হতে দেয়নি। এছাড়া, এটি প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ খরচ করত এবং দীর্ঘক্ষণ চললে অনেক গরম হয়ে যেত।

আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তুলনা

২০০০ সালের পর থেকে CRT-এর বিকল্প হিসেবে নতুন প্রযুক্তিগুলো আসতে শুরু করে। এলসিডি (Liquid Crystal Display) এবং এলইডি (Light Emitting Diode) প্রযুক্তি CRT-এর তুলনায় অনেক সুবিধা নিয়ে আসে।

বিষয়CRTLCD/LED
আকার ও ওজনখুব বড় এবং ভারীপাতলা ও হালকা
বিদ্যুৎ খরচঅনেক বেশিঅনেক কম
ছবির মানভালো, তবে বিকিরণযুক্তউজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ ও বিকিরণমুক্ত
স্থান দখলবেশি জায়গা প্রয়োজনকম জায়গা লাগে

সুবিধা (Advantages)

  1. উচ্চ মানের ছবি: CRT-এর ছবিগুলোর রঙের গভীরতা (color depth) এবং কনট্রাস্ট অনুপাত (contrast ratio) ছিল দুর্দান্ত। কিছু ক্ষেত্রে এটি আজও আধুনিক ডিসপ্লেকে টেক্কা দিতে পারে।

  2. দ্রুত রিফ্রেশ রেট: CRT-এর রিফ্রেশ রেট অনেক বেশি ছিল, ফলে দ্রুত গতিশীল ছবি দেখার সময় কোনো ধরনের মোশন ব্লার বা ঘোলাটে ভাব দেখা যেত না। বিশেষ করে গেমারদের কাছে এটি ছিল একটি বড় সুবিধা।

  3. বিভিন্ন রেজোলিউশন সমর্থন: CRT মনিটরগুলো বিভিন্ন রেজোলিউশনে ছবির মান পরিবর্তন না করে স্বচ্ছভাবে কাজ করতে পারত।

অসুবিধা (Disadvantages)

  1. আকারে বড় ও ভারী: এটি ছিল এর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। সহজে বহনযোগ্য না হওয়ায় এটি ডেস্কের অনেক জায়গা দখল করত।

  2. বেশি বিদ্যুৎ খরচ: আধুনিক ডিসপ্লেগুলোর তুলনায় CRT অনেক বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করত, যা পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর ছিল না।

  3. চোখের জন্য ক্ষতিকর: দীর্ঘ সময় CRT স্ক্রিনের সামনে থাকলে এর থেকে নির্গত বিকিরণ (radiation) চোখের জন্য ক্ষতিকর হতে পারত।


উপসংহার

যদিও CRT প্রযুক্তি এখন পুরোনো এবং জাদুঘরের প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে, তবুও আধুনিক ডিসপ্লে প্রযুক্তির ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। CRT-ই প্রথম ইলেকট্রনের মাধ্যমে দৃশ্যমান ছবি তৈরি করার ধারণাকে বাস্তব রূপ দিয়েছিল। আজকের এলইডি, এলসিডি এবং ওএলইডি প্রযুক্তিগুলো CRT-এর সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে আরও উন্নত ও কার্যকরী হলেও, তাদের মূল ভিত্তি এই পুরনো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ডিসপ্লে প্রযুক্তি থেকেই এসেছে। CRT শুধু একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র ছিল না, এটি ছিল একটি যুগের প্রতীক, যা ইলেকট্রনের আলোয় পৃথিবীকে প্রথমবার রঙিন ও চলমান ছবির জগতে প্রবেশ করিয়েছিল।

কোন মন্তব্য নেই

5ugarless থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.