📺 পর্ব – ১: টেলিভিশন সার্ভিসিং: একটি সম্ভাবনাময় পেশা

টেলিভিশন শুধু একটি বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং আধুনিক জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। খবর, বিনোদন, খেলাধুলা, বা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান—সবকিছুই এখন টিভির মাধ্যমে সহজলভ্য। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে যখন মানুষ ঘরে আবদ্ধ ছিল, তখন টেলিভিশন এবং অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফলে, বিভিন্ন ধরনের স্মার্ট টিভি, এলইডি টিভি এবং ৪কে/৮কে প্রযুক্তির টেলিভিশন এখন বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে।

তবে, দীর্ঘ ব্যবহারের কারণে এসব মূল্যবান ইলেকট্রনিক ডিভাইসে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন—পাওয়ার না আসা, স্ক্রিন ব্ল্যাক হয়ে যাওয়া, সাউন্ড না আসা, ব্যাকলাইট নষ্ট হওয়া, বা সফটওয়্যার জনিত জটিলতা। এসব সমস্যার সমাধানে টেলিভিশন সার্ভিসিং অপরিহার্য। এটি শুধু টিভি ব্যবহারকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি একটি লাভজনক এবং স্থিতিশীল পেশা হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

১. টেলিভিশন সার্ভিসিং কেন গুরুত্বপূর্ণ?

একটি নতুন টিভি কেনা সবসময়ই একটি বড় আর্থিক সিদ্ধান্ত। একটি ভালো মানের এলইডি বা স্মার্ট টিভির দাম সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য উল্লেখযোগ্য। তাই, যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন নতুন টিভি না কিনে বরং পুরনোটি মেরামত করিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

সাশ্রয়ী: নতুন টিভি কেনার চেয়ে তা মেরামত করানো অনেক বেশি সাশ্রয়ী। সামান্য একটি পার্টস বা কম্পোনেন্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে হাজার হাজার টাকা বাঁচানো সম্ভব।
পণ্যের আয়ু বৃদ্ধি: নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং সময়মতো সার্ভিসিং করালে টিভির আয়ু বহুলাংশে বেড়ে যায়। সঠিক পরিচর্যা একটি টিভিকে ১০-১৫ বছর পর্যন্ত সচল রাখতে পারে।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়: একটি ত্রুটিপূর্ণ টিভি অনেক সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ খরচ করে। পেশাদার সার্ভিসিং এর মাধ্যমে এই ধরনের সমস্যা সমাধান করে বিদ্যুৎ বিল কমানো যায়।
পরিবেশগত দিক: ইলেকট্রনিক বর্জ্য (E-waste) বর্তমানে বিশ্বব্যাপী একটি বড় সমস্যা। পুরনো টিভি ফেলে না দিয়ে মেরামত করে পুনরায় ব্যবহার করলে পরিবেশের উপর চাপ কমে।
ব্যবহারকারীর আস্থা: যখন কোনো পেশাদার টেকনিশিয়ান দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে কোনো সমস্যা সমাধান করে দেন, তখন ব্যবহারকারীর মধ্যে এক ধরনের আস্থা তৈরি হয়। এই আস্থা টেলিভিশন সার্ভিসিং পেশাকে আরও মজবুত করে।

২. বাংলাদেশে টিভি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ও সার্ভিসিংয়ের চাহিদা

বাংলাদেশ একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ, যেখানে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৮০% এরও বেশি পরিবারে এখন অন্তত একটি টেলিভিশন রয়েছে। শহরাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই টেলিভিশন আছে, আর গ্রামাঞ্চলেও এর ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে এলইড এবং স্মার্ট টিভির চাহিদা আকাশচুম্বী।

এই ব্যাপক ব্যবহার সরাসরি সার্ভিসিং-এর চাহিদাকে প্রভাবিত করেছে।

গ্রামীণ চ্যালেঞ্জ: গ্রামে অনেক সময় স্থানীয় ইলেকট্রনিক্স মিস্ত্রিরা মেরামতের কাজ করেন। কিন্তু আধুনিক এলইডি বা স্মার্ট টিভির জটিল সার্কিট ও সফটওয়্যার সংক্রান্ত সমস্যাগুলো তাদের পক্ষে সঠিকভাবে সমাধান করা প্রায় অসম্ভব। এর ফলে, গ্রামের মানুষরা সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হন।
শহরের চিত্র: শহরে বিভিন্ন ব্র্যান্ড কোম্পানির নিজস্ব সার্ভিস সেন্টার থাকলেও, সেখানে সবসময় দ্রুত এবং কার্যকর সেবা পাওয়া যায় না। দীর্ঘ অপেক্ষার তালিকা, উচ্চ সার্ভিস চার্জ এবং জটিল প্রক্রিয়া অনেক গ্রাহককে ফ্রিল্যান্স টেকনিশিয়ানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাড়তি চাহিদা: ফলস্বরূপ, দক্ষ ফ্রিল্যান্স টিভি টেকনিশিয়ান এবং ছোট সার্ভিস সেন্টারগুলোর চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে কয়েক কোটি টিভি ব্যবহারকারী আছেন, যাদের একটি বিশাল অংশ নিয়মিত সার্ভিসিং-এর উপর নির্ভরশীল। এটি স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে, এই খাতে দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে।

৩. টিভি সার্ভিসিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে গড়ার সুযোগ

বাংলাদেশের চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা দিন দিন বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ ডিগ্রির চেয়ে কারিগরি দক্ষতা (Technical Skills) থাকলে দ্রুত এবং সফলভাবে ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। টেলিভিশন সার্ভিসিং তেমনই একটি সম্ভাবনাময় পেশা।

চাহিদা বেশি, যোগান কম: প্রতিদিন হাজার হাজার টিভিতে কোনো না কোনো সমস্যা হচ্ছে, তাই মেরামতের কাজ কখনো বন্ধ হবে না। চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ টেকনিশিয়ানের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, যা এই পেশায় প্রবেশকারীদের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করে।
কম বিনিয়োগে শুরু: এই পেশা শুরু করতে বড় ধরনের মূলধন লাগে না। একটি ছোট ওয়ার্কশপ বা দোকান, কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যেমন—মাল্টিমিটার, সোল্ডারিং আয়রন, ডিসপ্লে টেস্টার এবং সর্বোপরি দক্ষতা থাকলেই কাজ শুরু করা যায়।
ফ্রিল্যান্সিং সুযোগ: শুধু দোকান নয়, বাসায় গিয়ে গ্রাহকদের সেবা দিয়েও ভালো আয় করা যায়। অনেক গ্রাহক তাদের মূল্যবান টিভি দোকান পর্যন্ত নিয়ে যেতে চান না, তাই হোম সার্ভিসিং-এর চাহিদা অনেক বেশি।
ব্র্যান্ড সার্ভিস সেন্টারে চাকরি: স্যামসাং, ওয়ালটন, সনি, এলজি সহ বড় বড় ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলোতে প্রশিক্ষিত টিভি টেকনিশিয়ান এর প্রচুর চাহিদা আছে। এই কোম্পানিগুলো নিয়মিত দক্ষ কর্মী নিয়োগ করে, এবং তাদের কাজের পরিবেশ ও বেতনও আকর্ষণীয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে সুযোগ: শুধু দেশেই নয়, মধ্যপ্রাচ্য (সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত), মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে দক্ষ বাংলাদেশি টিভি টেকনিশিয়ানদের ভালো চাহিদা রয়েছে। সেখানে তারা দেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি উপার্জন করতে পারেন।
নিজস্ব উদ্যোগ: দক্ষতা অর্জন করে নিজস্ব সার্ভিসিং প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসা শুরু করা যায়। সময়ের সাথে সাথে ব্যবসা বাড়লে আরও কর্মী নিয়োগ করে একটি বড় কোম্পানি গড়ে তোলা সম্ভব।

যারা এই মুহূর্তে টিভি সার্ভিসিং এর উপর দক্ষতা অর্জন করবেন, ভবিষ্যতে তারা একটি স্থিতিশীল এবং লাভজনক ক্যারিয়ার গড়তে পারবেন। এই পেশাটি শুধু চাকরির বাজারের চাপ কমায় না, বরং স্বাবলম্বী হওয়ারও সুযোগ করে দেয়।

পর্ব – ২ পর্ব – ৩ পর্ব – ৪ পর্ব – ৫ পর্ব – ৬ পর্ব – ৭