ইন্টারনেটের ইতিহাস: আবিষ্কার থেকে আজকের ডিজিটাল বিশ্ব
ভূমিকা: আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ইন্টারনেট
ইন্টারনেট—আধুনিক বিশ্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, গবেষণা—সবকিছুই এখন ইন্টারনেট-নির্ভর। কিন্তু এই শক্তিশালী এবং বৈপ্লবিক নেটওয়ার্ক কীভাবে আবিষ্কৃত হলো? এর পেছনের ইতিহাস কী এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত? এটি কি কেবল একক কোনো আবিষ্কার ছিল, নাকি অসংখ্য বিজ্ঞানীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল? চলুন, ইন্টারনেটের জন্ম থেকে শুরু করে আজকের অবস্থানে পৌঁছানোর সেই চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর কাহিনিটি জেনে নিই।
ঠান্ডা যুদ্ধ থেকে ইন্টারনেটের সূচনা: এক সামরিক প্রয়োজন
ইন্টারনেটের জন্মের পেছনে কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছিল না, বরং এর সূত্রপাত হয়েছিল শীতল যুদ্ধের (Cold War) চরম উত্তেজনা থেকে। ১৯৫০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার মধ্যে প্রযুক্তিগত এবং সামরিক প্রতিযোগিতা চরমে পৌঁছেছিল। ১৯৫৭ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ, স্পুটনিক-১, মহাকাশে পাঠাল, তখন যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগ ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠা করে অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (ARPA)। এর মূল লক্ষ্য ছিল প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি গবেষণা ও উন্নয়ন। ARPA-এর অন্যতম প্রধান কাজ ছিল এমন একটি বিকেন্দ্রীভূত কম্পিউটার নেটওয়ার্ক তৈরি করা যা পারমাণবিক হামলাতেও সচল থাকবে। যদি কোনো কারণে একটি বা একাধিক কম্পিউটার ধ্বংস হয়েও যায়, তাহলেও যেন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান অব্যাহত থাকে। এই ধারণাই ছিল ইন্টারনেটের প্রথম ধাপ।
ARPAnET: ইন্টারনেটের প্রথম ধাপ এবং প্রথম মাইলফলক
১৯৬০-এর দশকে ARPA-এর প্রকৌশলীরা বিকেন্দ্রীভূত কম্পিউটার নেটওয়ার্কের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই সময়েই লিওনার্ড ক্লিনরক (Leonard Kleinrock) একটি যুগান্তকারী ধারণা দেন, যার নাম “প্যাকেট সুইচিং” (Packet Switching)। এই পদ্ধতিতে বড় ডেটা ফাইলকে ছোট ছোট অংশে (packet) ভাগ করে বিভিন্ন পথে পাঠানো হয় এবং পরে গন্তব্যে গিয়ে সেই অংশগুলো আবার একত্রিত হয়। এই পদ্ধতিটি কেবল নিরাপদই ছিল না, বরং খুবই কার্যকরও ছিল।
ক্লিনরকের এই ধারণাকে বাস্তব রূপ দিতেই ১৯৬৯ সালে ARPA তৈরি করে ARPAnET, যা ইন্টারনেটের প্রোটোটাইপ হিসেবে পরিচিত। প্রথমে এটি চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারকে যুক্ত করেছিল:
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস (UCLA)
স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SRI)
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা বারবারা (UCSB)
ইউনিভার্সিটি অফ ইউটাহ
ইতিহাসের প্রথম অনলাইন বার্তাটি পাঠানো হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ২৯ অক্টোবর। UCLA-এর ছাত্র চার্লি ক্লাইন SRI-এর একটি কম্পিউটারকে যুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি "LOGIN" শব্দটি টাইপ করেন। যদিও নেটওয়ার্ক ক্র্যাশ করার কারণে শুধুমাত্র "LO" সফলভাবে পাঠানো হয়, এটিই ছিল ইন্টারনেট ইতিহাসের প্রথম সফল বার্তা এবং একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত।
ই-মেইল ও TCP/IP-এর জন্ম: ইন্টারনেটের মূল ভিত্তি
ARPAnET সফলভাবে চালু হওয়ার পর এর ব্যবহার আরও বাড়তে থাকে। ১৯৭১ সালে রে টমলিনসন (Ray Tomlinson) প্রথম ই-মেইল প্রোগ্রাম তৈরি করেন এবং ই-মেইল অ্যাড্রেসে "@" চিহ্ন ব্যবহার শুরু করেন। এটি ছিল যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি বিশাল পরিবর্তন।
এরপর ১৯৭০-এর দশকে ভেন্টন সার্ফ (Vinton Cerf) এবং বব কান (Bob Kahn) এক নতুন প্রোটোকল উদ্ভাবন করেন, যার নাম TCP/IP (Transmission Control Protocol/Internet Protocol)। এই প্রোটোকলটিই বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার নেটওয়ার্ককে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হয়, যা আজকের ইন্টারনেটের মূল ভিত্তি। তাদের এই যুগান্তকারী অবদানের জন্য সার্ফ ও কান-কে “ইন্টারনেটের জনক” বলা হয়।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW)-এর আবির্ভাব: সাধারণের জন্য ইন্টারনেটের দরজা খুলে দেওয়া
১৯৮০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেট মূলত শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এটিকে আরও সহজ এবং ব্যবহারবান্ধব করতে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স-লি (Tim Berners-Lee) কাজ শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি একটি প্রস্তাবনা দেন, যা পরে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) নামে পরিচিত হয়।
তিনি ওয়েবকে সহজলভ্য করতে তিনটি মূল প্রযুক্তি তৈরি করেন:
HTML (HyperText Markup Language): ওয়েবসাইট তৈরির জন্য একটি প্রোগ্রামিং ভাষা।
HTTP (HyperText Transfer Protocol): ওয়েবসাইটের ডেটা স্থানান্তরের জন্য প্রোটোকল।
URL (Uniform Resource Locator): ওয়েব পেজের ঠিকানা।
১৯৯১ সালে টিম বার্নার্স-লি প্রথম ওয়েবসাইটটি তৈরি করেন এবং এটিকে বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত করেন। এর পরেই ইন্টারনেট সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য হয়ে ওঠে।
বাণিজ্যিক ইন্টারনেটের সূচনা ও ব্রাউজারের বিপ্লব
১৯৯০-এর দশক ছিল ইন্টারনেটের বাণিজ্যিকীকরণের সময়। বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী (ISP) হিসেবে কাজ শুরু করে। ১৯৯৩ সালে প্রথম গ্রাফিক্যাল ওয়েব ব্রাউজার মোসাইক (Mosaic) বাজারে আসে। এর ফলে ব্যবহারকারীরা ওয়েবসাইটকে কেবল টেক্সট হিসেবে নয়, বরং ছবি এবং গ্রাফিক্সসহ দেখতে পায়। এটি ইন্টারনেটকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। পরবর্তীতে নেটস্কেপ, ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার, গুগল ক্রোম এবং ফায়ারফক্সের মতো ব্রাউজারগুলো ইন্টারনেটের ব্যবহারকে আরও সহজ ও সুবিধাজনক করে তোলে।
আধুনিক ইন্টারনেট: সামাজিক মাধ্যম থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
আজকের ইন্টারনেট কেবল তথ্য অনুসন্ধানের মাধ্যম নয়, বরং এটি আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যম: ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক এবং ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের যোগাযোগ, বিনোদন এবং তথ্য আদান-প্রদানের ধরন পাল্টে দিয়েছে।
ই-কমার্স: অ্যামাজন, দারাজ, আলিবাবার মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো বাণিজ্যের পদ্ধতি সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি: ক্লাউড কম্পিউটিং, এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এবং আইওটি (Internet of Things) ইন্টারনেটকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে এবং নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
উপসংহার
ইন্টারনেটের আবিষ্কার কোনো একক ব্যক্তির কাজ নয়। বরং এটি অসংখ্য বিজ্ঞানী, গবেষক এবং প্রকৌশলীর দীর্ঘ পরিশ্রমের ফল। ঠান্ডা যুদ্ধের সামরিক প্রয়োজন থেকে শুরু করে আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত পৃথিবী পর্যন্ত—ইন্টারনেটের যাত্রা এক অনন্য বিবর্তনের গল্প। এটি মানব সভ্যতাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
আজ এটি আমাদের জীবনকে আমূল পরিবর্তন করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও বড় সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। এই বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কোন মন্তব্য নেই