কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস: গণনাযন্ত্র থেকে এক বৈপ্লবিক যাত্রা

ভূমিকা: আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ

কম্পিউটার আজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষা, ব্যবসা, গবেষণা, বিনোদন, এমনকি আমাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রেও কম্পিউটার ছাড়া বর্তমান পৃথিবী কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু এই অত্যাধুনিক যন্ত্রটির জন্ম এক দিনে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে হাজার বছরের উদ্ভাবন এবং অসংখ্য বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রম। আজকের এই নিবন্ধে আমরা সংক্ষেপে কম্পিউটারের আবিষ্কারের সেই দীর্ঘ এবং চমকপ্রদ ইতিহাস জেনে নেব—গণনাযন্ত্রের সাধারণ ধারণা থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সুপারকম্পিউটার পর্যন্ত।


প্রাচীন গণনাযন্ত্র থেকে শুরু

"কম্পিউটার" শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো "গণনাকারী" যন্ত্র। প্রাচীনকালে মানুষ হিসাব-নিকাশের জন্য আঙুল, পাথর বা কাঠি ব্যবহার করত। এরপর প্রায় ৪০০০ বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক) অ্যাবাকাস (Abacus) নামে একটি গণনাযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়, যা আধুনিক কম্পিউটারের প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচিত। এটি ছিল একটি কাঠের ফ্রেম যার ভেতরে তারে পুঁতি সাজানো থাকত, যা দিয়ে যোগ-বিয়োগের মতো সাধারণ হিসাব করা যেত।

১৭শ শতকে ফরাসি গণিতবিদ ও দার্শনিক ব্লেইজ পাস্কাল একটি যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর তৈরি করেন, যা শুধু যোগ ও বিয়োগ করতে পারত। এরপরে জার্মান গণিতবিদ গটফ্রিড ভন লিবনিজ আরও উন্নত ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন, যা যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ—সব ধরনের গাণিতিক কাজ করতে পারত।

কম্পিউটারের জনক: চার্লস ব্যাবেজ

কম্পিউটারের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নামটি হলো ইংরেজ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজ (Charles Babbage)। তাকে আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয়। ১৮২২ সালে তিনি "ডিফারেন্স ইঞ্জিন" (Difference Engine)-এর নকশা করেন। এটি ছিল একটি বিশাল যান্ত্রিক যন্ত্র, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জটিল গাণিতিক হিসাব করতে পারত।

তবে তার সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন ছিল ১৮৪০-এর দশকে ডিজাইন করা "অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন" (Analytical Engine)। এই যন্ত্রটিতে ইনপুট, প্রসেসিং, মেমরি ও আউটপুট—একটি আধুনিক কম্পিউটারের এই চারটি মৌলিক অংশই বিদ্যমান ছিল। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামযোগ্য যান্ত্রিক কম্পিউটার। ব্যাবেজের এই কাজে তাকে সহায়তা করেছিলেন প্রতিভাবান গণিতবিদ অ্যাডা লাভলেস (Ada Lovelace), যিনি অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের জন্য প্রথম অ্যালগরিদম তৈরি করেন এবং তাকেই বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে সম্মান জানানো হয়।

ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের আবির্ভাব

২০শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারের ধারণাতেও বড় পরিবর্তন আসে। ১৯৩৮ সালে জার্মান প্রকৌশলী কনরাড যুসে (Konrad Zuse) বাইনারি সিস্টেম-এর উপর ভিত্তি করে Z1 নামে একটি কম্পিউটার তৈরি করেন। পরে ১৯৪১ সালে তার Z3 মডেলটি তৈরি হয়, যা ছিল বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামযোগ্য ডিজিটাল কম্পিউটার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা নাৎসি জার্মানির এনক্রিপ্টেড বার্তা ডিক্রিপ্ট করার জন্য কলোসাস (Colossus) নামে একটি কম্পিউটার তৈরি করে। এটি ছিল একটি বিশাল ইলেকট্রনিক যন্ত্র যা হাজার হাজার ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করত।

ENIAC: আধুনিক কম্পিউটার যুগের ভিত্তি

১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ENIAC (Electronic Numerical Integrator and Computer) তৈরি হয়। এটি ছিল আধুনিক কম্পিউটার যুগের প্রথম মাইলফলক। ২৭ টন ওজনের এই বিশাল যন্ত্রটিতে প্রায় ১৭,৪৬৮টি ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হয়েছিল। ENIAC ছিল বিশ্বের প্রথম সাধারণ কাজে ব্যবহৃত (General-purpose) ইলেকট্রনিক কম্পিউটার, যা দ্রুত এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাণিতিক হিসাব করতে পারত। যদিও এটি প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ করত এবং এটি আকারে বিশাল ছিল, তবুও এটিই আজকের কম্পিউটারের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

ট্রানজিস্টর ও মাইক্রোপ্রসেসরের বিপ্লব

১৯৫০-এর দশকে ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের পর কম্পিউটারের আকার ও কার্যকারিতায় এক বিশাল পরিবর্তন আসে। ট্রানজিস্টর ছিল ভ্যাকুয়াম টিউবের চেয়ে অনেক ছোট, দ্রুত এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। এর ফলে কম্পিউটারগুলো আকারে ছোট হতে শুরু করে।

পরবর্তী বিপ্লবটি আসে ১৯৭০-এর দশকে মাইক্রোপ্রসেসর (Microprocessor) আবিষ্কারের মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে ইনটেল (Intel) কোম্পানি 8080 নামে একটি মাইক্রোপ্রসেসর বাজারে আনে। এই ছোট চিপে একটি কম্পিউটারের সব গুরুত্বপূর্ণ অংশ (যেমন: সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট) সংযুক্ত ছিল। এর ফলে জন্ম নেয় পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি (PC)

পার্সোনাল কম্পিউটারের যুগ ও আজকের বিশ্ব

১৯৭৬ সালে স্টিভ জবসস্টিভ ওজনিয়াক অ্যাপল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং Apple-1 কম্পিউটার বাজারে আনেন। ১৯৮১ সালে আইবিএম (IBM) তাদের IBM PC বাজারে নিয়ে আসে, যা সাধারণ মানুষের জন্য সহজে ব্যবহারযোগ্য ছিল। এরপর গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস (GUI), মাউস এবং উন্নত অপারেটিং সিস্টেমের কারণে কম্পিউটার ব্যবহার আরও সহজ হয়, যা এই যন্ত্রকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়।

আজকের কম্পিউটারগুলো ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, স্মার্টফোন এবং স্মার্টওয়াচ আকারে আমাদের হাতে চলে এসেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ক্লাউড কম্পিউটিং এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT)-এর মতো আধুনিক প্রযুক্তি কম্পিউটারকে শুধু একটি গণনাযন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং মানব সভ্যতার প্রতিটি অগ্রগতির অংশ করে তুলেছে।

উপসংহার

অ্যাবাকাস থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সুপারকম্পিউটার—কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস হলো মানব উদ্ভাবনের এক অসাধারণ যাত্রা। চার্লস ব্যাবেজ, অ্যাডা লাভলেস, কনরাড যুসে এবং স্টিভ জবসের মতো উদ্ভাবকদের দূরদৃষ্টিই আমাদের আজকের এই প্রযুক্তি-নির্ভর যুগে এনেছে। কম্পিউটার এখন আর শুধু গণনাযন্ত্র নয়, এটি মানব সভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম চালিকাশক্তি।

কোন মন্তব্য নেই

5ugarless থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.