বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ইতিহাস: আলোকিত বিশ্বের এক অসাধারণ গল্প
ভূমিকা: বিদ্যুৎ—আধুনিক সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি
আধুনিক পৃথিবীতে বিদ্যুৎ ছাড়া একটি মুহূর্তও কল্পনা করা অসম্ভব। আলো জ্বালানো থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্প, চিকিৎসা, পরিবহন—সবকিছুই বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের চারপাশে থাকা এই সুবিশাল শক্তির উৎস এবং এর আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে বহু মানুষের দীর্ঘদিনের গবেষণা, পর্যবেক্ষণ এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের এই দীর্ঘ যাত্রাটি কোনো একক বিজ্ঞানীর অবদান নয়, বরং এটি মানবজাতির জ্ঞান এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার এক দারুণ প্রতিফলন। চলুন, বিদ্যুতের জন্ম থেকে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানোর সেই চমকপ্রদ কাহিনিটি জেনে নিই।
প্রাচীনকালের সূচনা: থেলস থেকে গিলবার্ট
বিদ্যুতের ইতিহাস শুরু হয় আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগে। প্রায় ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক থেলেস অফ মিলেটাস প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিদ্যুতের অস্তিত্ব লক্ষ্য করেন। তিনি দেখতে পান যে, অ্যাম্বার পাথরকে পশমের সাথে ঘষলে এটি শুকনো পালক, চুল বা অন্যান্য হালকা বস্তুকে আকর্ষণ করে। এটিই ছিল স্থির বিদ্যুৎ (static electricity)-এর প্রথম লিখিত পর্যবেক্ষণ। যদিও তখন এর কারণ সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছিল না, তবুও এটিই ছিল এক বিশাল আবিষ্কারের প্রথম পদক্ষেপ।
এরপর দীর্ঘ সময় ধরে এই বিষয়টি রহস্য হিসেবেই থেকে যায়। ১৬০০ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্ট তার বিখ্যাত বই De Magnete-তে এই ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। তিনি অ্যাম্বারের গ্রিক নাম ēlektron থেকে “ইলেকট্রিকাস” শব্দটি ব্যবহার করেন, যা পরবর্তীতে “ইলেকট্রিসিটি” বা বিদ্যুৎ শব্দে রূপান্তরিত হয়। গিলবার্ট আরও প্রমাণ করেন যে, অ্যাম্বার ছাড়াও হীরা, কাঁচ এবং অন্যান্য কিছু পদার্থও ঘর্ষণের ফলে একই ধর্ম দেখায়। তাকেই আধুনিক ইলেকট্রিসিটি এবং চুম্বকত্বের গবেষণার জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন: বজ্রপাত আসলে বিদ্যুৎ
১৭০০-এর দশকে আমেরিকান বিজ্ঞানী এবং রাজনীতিবিদ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বিদ্যুতের প্রকৃতি উন্মোচনে এক যুগান্তকারী অবদান রাখেন। সেই সময় পর্যন্ত, বজ্রপাতকে এক রহস্যময় প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে দেখা হতো। ফ্রাঙ্কলিন অনুমান করেন যে, আকাশের বজ্রপাত আসলে এক ধরনের বিদ্যুৎ। এই অনুমান প্রমাণ করতে তিনি এক দুঃসাহসিক পরীক্ষা করেন।
১৭৫২ সালে তার বিখ্যাত ঘুড়ি পরীক্ষা-তে তিনি একটি ভেজা ঘুড়ি উড়িয়ে দেন যার সঙ্গে একটি ধাতব চাবি ও একটি সিল্কের সুতো লাগানো ছিল। যখন বজ্রপাত শুরু হয়, তখন ঘুড়ির সুতোর মধ্য দিয়ে বিদ্যুতের স্পার্ক উৎপন্ন হয়, যা থেকে তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে আকাশের বজ্রপাত আসলেই বিদ্যুৎ। এই গবেষণার ফলস্বরূপ তিনি তড়িৎ-আহত দণ্ড (lightning rod) উদ্ভাবন করেন, যা আজও ভবনকে বজ্রপাতের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষা দেয়।
গ্যালভানি ও ভোল্টা: ব্যাটারির জন্ম
১৭৮০-এর দশকে ইতালীয় চিকিৎসক লুইজি গ্যালভানি এক অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ্য করেন। তিনি দেখেন যে, একটি লোহার রডে মৃত ব্যাঙের পা স্পর্শ করালে সেটি বৈদ্যুতিকভাবে লাফিয়ে ওঠে। তিনি এটিকে "প্রাণী বিদ্যুৎ" বলে অভিহিত করেন। এই ধারণাটি ছিল ভুল, কিন্তু এটিই পরবর্তী গবেষণার দরজা খুলে দেয়।
গ্যালভানির এই পর্যবেক্ষণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইতালীয় পদার্থবিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা গবেষণা শুরু করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে বিদ্যুতের উৎস ব্যাঙের পেশী নয়, বরং ভিন্ন দুটি ধাতুর রাসায়নিক বিক্রিয়া। এই আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে ১৮০০ সালে তিনি ভোল্টাইক পাইল নামক পৃথিবীর প্রথম ব্যাটারি আবিষ্কার করেন। এই ব্যাটারিটি ছিল তামা এবং দস্তার কয়েকটি ডিস্কের স্তূপ, যার মাঝে লবণাক্ত কাগজ রাখা হতো। ভোল্টার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের সম্মানার্থে বিদ্যুতের বিভব পার্থক্য পরিমাপের একককে “ভোল্ট” নামকরণ করা হয়েছে।
মাইকেল ফ্যারাডে: জেনারেটরের জনক
১৮০০-এর দশকের শুরুতে বিদ্যুৎ একটি গবেষণাগারভিত্তিক বিষয় ছিল। এটি দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব ছিল না। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটান ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে। ১৮৩১ সালে তিনি আবিষ্কার করেন তড়িৎ-চুম্বকীয় আবেশ (Electromagnetic Induction)। তিনি দেখান, একটি চুম্বককে তারের কুণ্ডলীর মধ্যে নড়াচড়া করালে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তিনি বিদ্যুৎ উৎপাদনের মৌলিক নীতিটি উন্মোচন করেন।
ফ্যারাডের এই আবিষ্কার থেকেই জন্ম নেয় জেনারেটর বা ডায়নামো, যা যান্ত্রিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। তিনি বৈদ্যুতিক মোটরের ধারণাও দেন, যা আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ফ্যান, ওয়াশিং মেশিন এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির ভিত্তি। ফ্যারাডের কাজ বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ খুলে দেয়।
এডিসন বনাম টেসলা: 'কারেন্টের যুদ্ধ' এবং আধুনিক বিদ্যুতের সূচনা
১৮০০-এর দশকের শেষভাগে বিদ্যুৎকে বাণিজ্যিকভাবে শহরগুলোতে সরবরাহের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা শুরু হয়। এ সময় দুই মহান বিজ্ঞানী, টমাস এডিসন এবং নিকোলা টেসলার মধ্যে এক তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা ইতিহাসে “কারেন্টের যুদ্ধ” নামে পরিচিত।
টমাস এডিসন: তিনি ডাইরেক্ট কারেন্ট (DC) সিস্টেমের প্রবক্তা ছিলেন। ১৮৮২ সালে নিউ ইয়র্কে তিনি প্রথম বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেন, যা ডিসি বিদ্যুৎ সরবরাহ করত। ডিসি বিদ্যুতের প্রধান অসুবিধা ছিল এটি বেশি দূর পর্যন্ত পাঠানো যেত না এবং ভোল্টেজ পরিবর্তন করা কঠিন ছিল।
নিকোলা টেসলা: টেসলা অল্টারনেটিং কারেন্ট (AC) সিস্টেম তৈরি করেন। এসি বিদ্যুৎকে সহজেই ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে উচ্চ বা নিম্ন ভোল্টেজে রূপান্তর করা যায় এবং এটি দূর-দূরান্তে পাঠানো সম্ভব। এই সুবিধাগুলো এসি-কে ডিসি-র চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর করে তুলেছিল।
এডিসন তার ডিসি সিস্টেমকে জনপ্রিয় করার জন্য অনেক চেষ্টা করেন, এমনকি এসি বিদ্যুতের বিপদ সম্পর্কে মানুষকে ভয় দেখানোরও চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসি বিদ্যুতের কার্যকারিতা ও সুবিধার কারণে এটি জয়ী হয়। আজ সারা বিশ্বে যে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ব্যবহৃত হয়, তার সিংহভাগই অল্টারনেটিং কারেন্ট (AC) সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
বিদ্যুৎ ও আধুনিক সভ্যতা
বিদ্যুৎ আবিষ্কার কেবল অন্ধকার দূর করেনি, বরং এটি মানব সভ্যতার প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এটি শিল্প বিপ্লবকে আরও গতিশীল করেছে, কারখানার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করেছে। টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, এবং স্মার্টফোনের মতো প্রযুক্তির জন্ম দিয়েছে, যা আমাদের যোগাযোগ এবং তথ্য আদান-প্রদানের ধরণকে আমূল পরিবর্তন করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক্স-রে এবং অন্যান্য উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার সম্ভব করেছে। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও এটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
উপসংহার
বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ইতিহাস এক অসাধারণ যাত্রা—থেলেসের অ্যাম্বার পাথরের পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে ফ্রাঙ্কলিনের ঘুড়ি, ভোল্টার ব্যাটারি, ফ্যারাডের ডায়নামো এবং এডিসন-টেসলার ঐতিহাসিক 'কারেন্টের যুদ্ধ'-এর মধ্য দিয়ে আজকের বৈদ্যুতিক বিশ্ব গড়ে উঠেছে। এটি কোনো একক ব্যক্তির আবিষ্কার নয়, বরং এটি মানবজাতির সম্মিলিত জ্ঞান ও উদ্ভাবনী চেতনার এক দারুণ উদাহরণ। বিদ্যুৎ শুধু আমাদের জীবনে আলো নিয়ে আসেনি, বরং মানুষের জীবনযাত্রা, শিল্প এবং প্রযুক্তিকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে। বলা যায়, বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক সভ্যতা কল্পনাই করা যায় না।

কোন মন্তব্য নেই