মোবাইল আবিষ্কারের কাহিনি: পকেটে পুরে রাখা যোগাযোগের বিপ্লব

মোবাইল ফোন! আমাদের হাতে থাকা এই ছোট যন্ত্রটি এখন আর কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, এই মোবাইল ফোনের জন্ম কীভাবে হয়েছিল? আজকের এই স্মার্টফোনের পেছনে রয়েছে প্রায় ১০০ বছরের দীর্ঘ এক ইতিহাস। এই পোস্টে আমরা মোবাইল ফোনের আবিষ্কারের সেই অজানা কাহিনি নিয়ে আলোচনা করব।

মোবাইলের প্রাথমিক ধারণা

মোবাইল ফোন আবিষ্কারের প্রথম ধারণা আসে ১৯ শতকের শেষের দিকে। ১৮০০ সালের দিকে বিভিন্ন বিজ্ঞানী তারবিহীন যোগাযোগের জন্য চেষ্টা করছিলেন। তবে সেই সময় তাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবল তথ্য বা বার্তা পাঠানো। ১৯০৮ সালে কেনটাকির একজন উদ্ভাবক, নাথান স্টাফেল্ড, তারবিহীন টেলিফোনের একটি পেটেন্ট লাভ করেন। এটি ছিল মূলত এক ধরনের রেডিও ফোন, যা কিছু সীমিত দূরত্বে কাজ করত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সৈন্যরা তাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য কিছু তারবিহীন টেলিফোন ব্যবহার করত। তবে এগুলো ছিল খুবই ভারী এবং শুধুমাত্র সীমিত পরিসরে কাজ করত।

১৯৪০-এর দশক: প্রথম মোবাইল টেলিফোন পরিষেবা

মোবাইল ফোনের আধুনিক ধারণার জন্ম হয় ১৯৪০-এর দশকে। ১৯৪৬ সালে আমেরিকান কোম্পানি AT&T বেল ল্যাবস প্রথম বারের মতো 'মোবাইল টেলিফোন পরিষেবা' চালু করে। এই পরিষেবাটি সাধারণ গাড়ির সাথে যুক্ত ছিল এবং এটি এক ধরনের রেডিও ট্রান্সমিটার ও রিসিভার ব্যবহার করত। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। সেই সময় শুধু একজন ব্যবহারকারী একটি চ্যানেলে কথা বলতে পারতেন এবং এর জন্য আলাদা অপারেটরের সাহায্য লাগত।

১৯৫০-এর দশকে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হয় এবং এর পরিসর বাড়ে। তবে এই ফোনগুলো ছিল খুবই বড়, দামি এবং শুধুমাত্র গাড়িতে ব্যবহার করা যেত।

মার্টিন কুপার: মোবাইল ফোনের জনক

১৯৭৩ সালের ৩রা এপ্রিল, একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনেই মোবাইল ফোনের জগতে বিপ্লব ঘটে। মোটোরোলা (Motorola) কোম্পানির প্রকৌশলী মার্টিন কুপার বিশ্বের প্রথম পোর্টেবল মোবাইল ফোন তৈরি করেন। তিনি নিউইয়র্কের রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বেল ল্যাবসের প্রধান ড. জোয়েল এঙ্গেলকে প্রথম মোবাইল কলটি করেন।

কুপারের তৈরি প্রথম মোবাইল ফোনটির ওজন ছিল প্রায় ১.১ কিলোগ্রাম (প্রায় একটি ইটের ওজনের সমান) এবং এটি দিয়ে মাত্র ৩০ মিনিট কথা বলা যেত। এর ব্যাটারি চার্জ করতে সময় লাগত প্রায় ১০ ঘণ্টা। এই ফোনটির নাম ছিল Motorola DynaTAC 8000x। যদিও এটি দেখতে আজকের মোবাইলের মতো ছিল না, এটিই ছিল আধুনিক মোবাইল ফোনের পূর্বসূরী।

১৯৮০-এর দশক: প্রথম বাণিজ্যিক মোবাইল ফোন

মার্টিন কুপারের আবিষ্কারের প্রায় ১০ বছর পর ১৯৮৩ সালে Motorola DynaTAC 8000x বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসে। এর দাম ছিল প্রায় ৪০০০ ডলার (যা বর্তমান মুদ্রায় প্রায় ১০,০০০ ডলারের সমান)। এই ফোনটি ছিল সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষের জন্য। এর আকার ও দামের কারণে এটি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না।

এই সময়ে নোকিয়া (Nokia) এবং এরিকসন (Ericsson)-এর মতো কোম্পানিগুলোও মোবাইল ফোন তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমে আসে। ১৯৮৭ সালে নোকিয়া তাদের প্রথম পোর্টেবল ফোন Mobira Cityman 900 বাজারে আনে, যা ছিল তুলনামূলকভাবে হালকা এবং ছোট।

৯০-এর দশক: মোবাইল ফোনের বিবর্তন এবং জিএসএম প্রযুক্তি

১৯৯০-এর দশকে মোবাইল ফোনের জগতে বড় পরিবর্তন আসে। এই সময়ে জিএসএম (GSM) প্রযুক্তি চালু হয়, যা মোবাইল যোগাযোগকে ডিজিটাল যুগে নিয়ে আসে। এর ফলে ভয়েস কোয়ালিটি অনেক উন্নত হয় এবং আন্তর্জাতিক রোমিংয়ের সুবিধা সহজ হয়।

এই দশকেই নোকিয়া, মটোরোলা এবং এরিকসন বিভিন্ন মডেলের ছোট এবং আরও কার্যকর মোবাইল ফোন বাজারে আনে। ১৯৯২ সালে নোকিয়া প্রথম টেক্সট মেসেজ বা এসএমএস (SMS)-এর সুবিধা নিয়ে আসে। ১৯৯৭ সালে প্রথম ক্যামেরাযুক্ত ফোন বাজারে আসে এবং ১৯৯৯ সালে জাপানের কায়োসেরা (Kyocera) কোম্পানি প্রথম মোবাইল ফোন তৈরি করে, যা দিয়ে ইন্টারনেট ব্রাউজ করা যেত।

২০০০-এর দশক: স্মার্টফোনের জন্ম

২০০০ সালের পরে মোবাইল ফোন কেবল কথা বলার যন্ত্র থেকে একটি বহুমুখী স্মার্ট যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। ২০০৭ সালে অ্যাপল (Apple) তাদের প্রথম আইফোন (iPhone) বাজারে আনে। আইফোন তার টাচস্ক্রিন এবং অ্যাপ স্টোরের মাধ্যমে মোবাইল ফোনের ধারণাকে সম্পূর্ণ নতুন এক দিকে নিয়ে যায়। এরপর স্যামসাং, গুগল এবং অন্যান্য কোম্পানিগুলোও এই প্রতিযোগিতায় নেমে আসে।

উপসংহার

আজকের মোবাইল ফোন একটি ছোট কম্পিউটার, যা আমাদের পকেটে থাকে। মোবাইল আবিষ্কারের এই দীর্ঘ যাত্রায় অনেক বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবকের অবদান রয়েছে। মার্টিন কুপারের প্রথম মোবাইল কল থেকে শুরু করে আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) যুগে, মোবাইল ফোন আমাদের জীবনযাত্রাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে।

এই কাহিনি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? আমাদের কমেন্ট করে জানান।

কোন মন্তব্য নেই

5ugarless থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.