কলম আবিষ্কারের কাহিনি: মানব সভ্যতার লেখনী যাত্রার ইতিহাস

কলম! আমাদের হাতে থাকা এই ছোট যন্ত্রটি ছাড়া লেখালেখি কল্পনা করা অসম্ভব। স্কুল, কলেজ, অফিস থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার অপরিহার্য। কিন্তু এই সাধারণ অথচ অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রটির জন্ম কীভাবে হয়েছিল? এর পেছনের ইতিহাস কী এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত? এই পোস্টে আমরা কলম আবিষ্কারের সেই দীর্ঘ এবং চমকপ্রদ কাহিনি নিয়ে আলোচনা করব।

শুরুর কথা: প্রাচীন যুগের লেখনী পদ্ধতি

কলম আবিষ্কারের অনেক আগে মানুষ বিভিন্ন উপায়ে নিজেদের ভাবনা বা তথ্য লিখে রাখত। প্রাচীনকালে গুহাচিত্রে আঁকা ছবিই ছিল যোগাযোগের প্রথম মাধ্যম। এরপর বিভিন্ন সভ্যতায় লেখার পদ্ধতি বিকশিত হয়:

  • মেসোপটেমিয়া (প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): সুমেরীয়রা কাদা মাটির ফলকে (clay tablets) কীলক বা স্টাইলাস (stylus) দিয়ে লিখত। এটি ছিল কীলকলিপি বা কিউনিফর্ম (cuneiform) লেখার প্রথম রূপ।

  • প্রাচীন মিশর (প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): মিশরীয়রা প্যাপিরাস (papyrus) নামক গাছের ছাল থেকে তৈরি কাগজে নলখাগড়া বা বাঁশের সরু কাঠি দিয়ে লিখত। কালি তৈরি হতো প্রাকৃতিক রঞ্জক পদার্থ, যেমন—কালি গাছ বা কাঠকয়লার গুঁড়ো মিশিয়ে।

এই পদ্ধতিগুলো ছিল খুবই কষ্টসাধ্য এবং লেখাকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা ছিল কঠিন।

ফেদার কলম (Quill Pen): দীর্ঘ রাজত্ব

পঞ্চম শতাব্দীর দিকে ইউরোপে ফেদার কলম বা পাখির পালকের কলমের ব্যবহার শুরু হয়। হাঁস, রাজহাঁস বা টার্কির পালক ব্যবহার করে এই কলম তৈরি করা হতো। পালকের অগ্রভাগ সূঁচালো করে কেটে কালি দিয়ে লেখা হতো। এই কলমগুলো প্রায় ১৩০০ বছর ধরে লেখনী জগতে রাজত্ব করেছে।

ফেদার কলমের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল:

  • এটি খুব দ্রুত ফুরিয়ে যেত এবং ঘন ঘন নতুন করে পালক ছাঁটতে হতো।

  • একবার কালিতে ডুবিয়ে খুব বেশি লেখা যেত না।

  • এটি ভঙ্গুর ছিল এবং সহজে ভেঙে যেত।

তবুও, ফেদার কলমই ছিল আধুনিক কলমের পথপ্রদর্শক।

ধাতব নিবের আগমন: কলমের আধুনিকীকরণ

১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে ধাতব নিবের (metal nib) ব্যবহার শুরু হয়। স্টিলের নিব কাগজের ওপর মসৃণভাবে চলত এবং ফেদার কলমের তুলনায় অনেক বেশি টেকসই ছিল। ১৮২২ সালে জন মিচেল (John Mitchell) বাণিজ্যিকভাবে স্টিলের নিব উৎপাদন শুরু করেন, যা কলম শিল্পে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ধাতব নিবের ফলে লেখা আরও দ্রুত এবং ঝরঝরে হয়।

ফাউন্টেন পেন (Fountain Pen): কালির বিপ্লবী সমাধান

ধাতব নিবের সমস্যা ছিল যে, বারবার কালির পাত্রে ডুবিয়ে লিখতে হতো। এই সমস্যার সমাধান আসে ফাউন্টেন পেন আবিষ্কারের মাধ্যমে। ফাউন্টেন পেনের ভেতরে একটি রিজার্ভার বা কালি সংরক্ষণের স্থান থাকত, যা নিবের মাধ্যমে কালিকে কাগজের ওপর নিয়ে আসত।

প্রথম দিকের ফাউন্টেন পেনের ধারণা ১৮শ শতাব্দীর দিকে এলেও, এর বাণিজ্যিক সাফল্য আসে ১৯শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।

  • পেটেন্ট এবং উদ্ভাবন: ১৮৮৪ সালে আমেরিকান উদ্ভাবক লুইস ওয়াটারম্যান (Lewis Waterman) একটি কার্যকর ফাউন্টেন পেন তৈরি করেন এবং এর পেটেন্ট লাভ করেন। তার কলমটি ছিল উন্নত ফিড সিস্টেম (feed system)-এর উপর নির্ভরশীল, যা কালিকে মসৃণভাবে নিবের দিকে প্রবাহিত করত এবং কালির ফোটা পড়া (inking blot) সমস্যা কমিয়ে দিত। ওয়াটারম্যান কোম্পানি আজও ফাউন্টেন পেন তৈরি করে।

ফাউন্টেন পেন আবিষ্কার লেখনীর জগতে এক বিশাল বিপ্লব নিয়ে আসে। এটি লেখার প্রক্রিয়াকে অনেক সহজ এবং সুবিধাজনক করে তোলে।

বলপয়েন্ট পেন (Ballpoint Pen): সর্বব্যাপী কলম

২০শ শতাব্দীতে আসে কলমের সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন— বলপয়েন্ট পেন (Ballpoint Pen)। এটি ছিল ফাউন্টেন পেনের সীমাবদ্ধতা দূর করার একটি সমাধান। ফাউন্টেন পেন অনেক সময় কালি ছড়াত এবং নির্দিষ্ট ধরনের কাগজ ছাড়া ভালো কাজ করত না।

  • হাঙ্গেরীয় সাংবাদিকের উদ্ভাবন: বলপয়েন্ট পেনের ধারণা প্রথম দেন হাঙ্গেরীয় সাংবাদিক লাজলো বিরো (László Bíró)। তিনি লক্ষ্য করেন যে, খবরের কাগজ ছাপার কালি দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং দাগ পড়ে না। তাই তিনি সেই কালি দিয়ে লেখার জন্য একটি কলম তৈরির চেষ্টা করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি একটি কলম তৈরি করেন, যার নিবের জায়গায় একটি ছোট বল (ball) ছিল। এই বলটি ঘোরার সময় কালি নিয়ে আসত এবং দ্রুত শুকিয়ে যেত।

  • বাণিজ্যিক সাফল্য: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্স বিরোর বলপয়েন্ট পেন ব্যবহার করা শুরু করে, কারণ উচ্চতায় ফাউন্টেন পেনে কালি জমে যেত বা ছড়িয়ে পড়ত, কিন্তু বলপয়েন্ট পেনে এমন সমস্যা হতো না। যুদ্ধের পর, এই কলম সাধারণ মানুষের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকান কোম্পানি Bic এবং Paper Mate বাণিজ্যিকভাবে বলপয়েন্ট পেন তৈরি করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়।

বলপয়েন্ট পেন সস্তা, নির্ভরযোগ্য এবং সব ধরনের কাগজে লেখার উপযোগী হওয়ায় এটি বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় কলমে পরিণত হয়।

উপসংহার

প্রাচীন কাদা ফলক থেকে শুরু করে আজকের ফাউন্টেন বা বলপয়েন্ট পেন পর্যন্ত—কলমের এই যাত্রা মানব সভ্যতার জ্ঞানচর্চা এবং যোগাযোগের এক দীর্ঘ এবং বিবর্তনশীল ইতিহাস। চার্লস ব্যাবেজের মতো বিজ্ঞানীরা যেমন কম্পিউটার আবিষ্কার করে গণনার জগতকে সহজ করেছেন, তেমনি লুইস ওয়াটারম্যান এবং লাজলো বিরোর মতো উদ্ভাবকদের জন্যই আজ আমরা সহজে লিখতে পারি। কলম শুধু একটি যন্ত্র নয়, এটি আমাদের চিন্তা, জ্ঞান এবং সৃজনশীলতার বাহক।

কলমের এই ইতিহাস সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? আপনার প্রিয় কলম কোনটি? কমেন্ট করে আমাদের জানান।


কোন মন্তব্য নেই

5ugarless থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.