পাখাওয়ালার করুণ ইতিহাস

পা দিয়ে পাখা টানছেন পাংখাপুলার, কাজের ফাঁকে একটু বিশ্রামের চেষ্টা। ছবি: এলসওর্থ হান্টিংটন, দ্য হিউম্যান হ্যাবিট্যাট, ভায়া উকিমিডিয়া কমনস

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের ভারতবর্ষের কথা। সেই সময়, যখন ব্রিটিশরা এখানকার অসহ্য গরম থেকে বাঁচতে একদল ভারতীয় ভৃত্যকে ব্যবহার করত, যাদের বলা হতো পাখাওয়ালা। ভারতবর্ষের উষ্ণ আবহাওয়া ব্রিটিশদের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছিল, যা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছিল। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য জন্ম নিয়েছিল এক নিষ্ঠুর শ্রম-ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে পাখাওয়ালারা ছিল সবচেয়ে বড় শিকার।

ঘুমকে ঘিরে ব্রিটিশদের অর্থনীতি

ব্রিটিশরা যখন প্রথম ভারতবর্ষে আসে, এখানকার চরম তাপ, মশা, মাছি এবং আকস্মিক ঝড়ের কারণে তাদের ঘুমের খুব সমস্যা হতো। বিশেষ করে এপ্রিল থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাতের পর রাত জেগে থাকতে হতো তাদের। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে অনেক ব্রিটিশ কর্মকর্তা সকালে দেরি করে কাজ শুরু করতেন এবং সারাদিন তাদের মেজাজ খিটখিটে থাকত। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশরা বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শৈলশহর গড়ে তোলা, পাতলা ভারতীয় পোশাক পরা, ঠান্ডা পানিতে গোসল করা, এবং বিশেষভাবে তৈরি বিছানা ব্যবহার করা। তবে সবচেয়ে কার্যকর এবং নিষ্ঠুর সমাধান ছিল পাখাওয়ালাদের নিয়োগ করা।

পাখার নিচে পড়ছেন নারী। ছবি: ব্রিটিশ লাইব্রেরি ভায়া উকিমিডিয়া কমনস


পাখাওয়ালার অমানবিক জীবন

ব্রিটিশরা গ্রীষ্মকালে গরম থেকে বাঁচতে যে ভারতীয় ভৃত্যদের নিয়োগ করত, তাদেরই পাংখাওয়ালা বা পাখাওয়ালা বলা হতো। এদের মূল কাজ ছিল বড় বড় পাখা দড়ি দিয়ে টেনে বাতাস করা, যা আদালত, ব্যারাক, ব্রিটিশ দপ্তর, এবং ইউরোপীয়দের বাড়িতে লাগানো থাকত। পাখাওয়ালারা কেবল ভোর ও সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম পেত। বাকি সময়, অর্থাৎ দিন ও রাতের বেশিরভাগ সময় তাদের কাজ করে যেতে হতো।

এই পাখাওয়ালাদের জীবন ছিল অমানবিক। তারা দিন-রাত খেটে যেতেন সামান্য কিছু বেতনের বিনিময়ে। ১৮৮০-এর দশকে তাদের মাসিক বেতন ছিল মাত্র তিন রুপি। দিনের বেলা পাখাওয়ালারা বাড়ির অন্যান্য কাজ করত, আর রাতে পাখা টেনে মনিবদের আরাম নিশ্চিত করত।


নিষ্ঠুরতার নির্মম ইতিহাস

পাখাওয়ালাদের কাজ থেকে সর্বোচ্চ ফল পেতে ব্রিটিশরা নানা ধরনের নিষ্ঠুর কৌশল অবলম্বন করত। গবেষক রিতম সেনগুপ্ত তার গবেষণায় এই গার্হস্থ্য শ্রম এবং ঔপনিবেশিক শোষণের দিকগুলো তুলে ধরেছেন। ঘুমের প্রয়োজনের কারণে জন্ম নেওয়া এই জাতিগত সহিংসতা ছিল এক নির্মম বাস্তবতা।

ব্রিটিশ অফিসারদের ঘুমের সময় পাখাওয়ালারাও প্রায়ই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। এতে মনিবদের ঘুম ভেঙে গেলে তাদের নির্মম শাস্তির মুখে পড়তে হতো। টি.এস. অ্যাবট-এর লেখা থেকে জানা যায়, পাখাওয়ালা ঘুমিয়ে পড়লে ব্রিটিশ মনিবরা রেগে গিয়ে তাদের গালিগালাজ করতেন, লাথি মারতেন, বা মাথায় গাঁট্টা মারতেন। এমনকি জল ভর্তি জগ বা মাটির পাত্র ছুঁড়ে মারতেও দ্বিধা করতেন না তারা।

অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, পাখাওয়ালাদের ঘুম ভাঙানোর জন্য অভিনব সব পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো।

  • চিনির ব্যবহার: পাখাওয়ালাদের বসার স্থানে চিনি ছড়িয়ে দেওয়া হতো, যাতে তারা ঘুমিয়ে পড়লে পিঁপড়া এসে তাদের ঘামে ভেজা শরীরে কামড় বসায়।

  • হাঁসের ব্যবহার: কিছু ক্ষেত্রে পাখাওয়ালার বাহুতে একটি হাঁস বেঁধে দেওয়া হতো। কাজের সময় হাঁসটি হাত থেকে পড়ে গেলে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হতো।

  • চুলের ব্যবহার: অনেক শ্বেতাঙ্গ তাদের পাখাওয়ালাদের চুল বেঁধে রাখতেন, যাতে তারা ঘুমিয়ে পড়লে চুলের টানে ঘুম ভেঙে যায়।

এই সব পদ্ধতি থেকে বোঝা যায়, ব্রিটিশদের কাছে পাখাওয়ালারা ছিল নিছকই এক শ্রমের উৎস, কোনো মানুষ নয়।

প্রতিশোধ এবং প্রতিরোধের সামান্য ঝলক

এত অত্যাচারের মুখেও পাখাওয়ালারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ খুঁজত। ঈগল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, পাখাওয়ালারাও মাঝেমধ্যে মনিবদের উপর প্রতিশোধ নিত। যেমন, মনিব যখন কাগজপত্র নিয়ে বসতেন, তখন তারা পাখা জোরে টেনে সব কাগজ উড়িয়ে দিত। অথবা, মনিব আস্তে পাখা টানার নির্দেশ দিলেও তারা ইচ্ছাকৃতভাবে জোরে পাখা টানত, যেন তারা আদেশটি ভুল বুঝেছে।

উপসংহার

ঔপনিবেশিক আমলের পাখাওয়ালার ইতিহাস কেবল একটি চাকরি বা সেবার গল্প নয়, বরং এটি ব্রিটিশদের আরামের জন্য ভারতীয়দের ওপর চালানো অমানবিক শোষণ এবং সহিংসতার এক করুণ আখ্যান। ব্রিটিশরা নিজেদের সুবিধার জন্য 'ঘুম অর্থনীতি' গড়ে তুলেছিল, যেখানে পাখাওয়ালারা ছিল সেই অর্থনীতির নীরব, নিরন্তর এবং নির্যাতিত অংশ। লন্ডনের তাপমাত্রার এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের সেই পাখাওয়ালার কথা মনে পড়লে ঔপনিবেশিক শাসনের অন্ধকার দিকটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাখাওয়ালার ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আরাম আর বিলাসের পেছনে অনেক সময় লুকিয়ে থাকে অন্যের শ্রম ও যন্ত্রণার করুণ গল্প।

কোন মন্তব্য নেই

5ugarless থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.