জীবন ও শিক্ষাজীবন: স্বপ্ন ও বাস্তবতার মেলবন্ধন
ছোটবেলা থেকেই মধুসূদন দত্তের মেধার দ্যুতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়াশোনা করার সময় তিনি ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। শেক্সপিয়র ও মিলটনের মতো বিশ্বখ্যাত কবিদের রচনা তাঁকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সেই সময়ে তিনি একজন বড় ইংরেজি কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন—হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নাম পরিবর্তন করে হন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
পিতার সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে তিনি মাদ্রাজে চলে যান এবং সেখানে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই সময়েই তিনি ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হন এবং নিজের প্রতিভার সঠিক পথ খুঁজে পান।
বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের অবদান: আধুনিকতার পথিকৃৎ
মধুসূদন দত্তের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন। এর আগে বাংলা কবিতা ছিল পয়ার ছন্দের বাঁধনে আবদ্ধ। অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলা কবিতার গতি এবং প্রকাশভঙ্গিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই ছন্দে রচিত তাঁর কালজয়ী মহাকাব্য 'মেঘনাদবধ কাব্য' (Meghnad Badh Kabya) বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ সৃষ্টি। এই কাব্যে তিনি রামায়ণ থেকে উপাখ্যান নিলেও, রাবণের চরিত্রকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রিত করেছেন, যা পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ এবং ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’। এই কবিতাগুলো তাঁর প্রতিভার বহুমুখী দিক তুলে ধরে।
বাংলা নাটকে মধুসূদনের ভূমিকা
মধুসূদন দত্ত কেবল একজন মহাকবিই ছিলেন না, তিনি বাংলা নাটকের জগতেও নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। তিনিই প্রথম সফল বাংলা প্রহসন রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত প্রহসনগুলো হলো ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার ও অনাচারকে তিনি এই প্রহসনগুলোর মাধ্যমে হাস্যরসের ছলে তুলে ধরেন। তাঁর অন্যান্য নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’ এবং ‘কৃষ্ণকুমারী’।
জীবনের শেষ পর্যায়: সংকট ও চিরবিদায়
১৮৭২ সালে তিনি সপরিবারে বিলাত (ইংল্যান্ড) গমন করেন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য। কিন্তু সেখানে তিনি নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়েন। এই কঠিন সময়ে মহাপ্রাণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর পাশে দাঁড়ান এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাঁকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনেন। দেশে ফিরে তিনি ব্যারিস্টারি পেশায় যোগ দেন, কিন্তু শেষ জীবনেও তাঁকে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হয়।
বাংলা সাহিত্যের এই অমর প্রতিভা ১৮৭৩ সালের ২৯শে জুন মাত্র ৪৯ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কেবল মাতৃভাষাই পারে একজন লেখককে অমরত্ব দিতে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রতিভা, একাগ্রতা এবং মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকলে একজন মানুষ কতটা অসাধারণ সৃষ্টি করতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই