বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের কাহিনি: এক আলোকিত বিপ্লবের ইতিহাস


বৈদ্যুতিক বাতি, যা আজকের দিনে আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ, তার আবিষ্কার মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি শুধু একটি যন্ত্রের আবিষ্কার ছিল না, বরং ছিল অন্ধকারকে জয় করে পৃথিবীকে আলোকিত করার এক অবিস্মরণীয় বিপ্লব। কিন্তু কে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেন? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকের মনেই প্রথম যে নামটি আসে, তা হলো টমাস এডিসন। তবে বাস্তবতা হলো, এডিসন একা এই আবিষ্কার করেননি, বরং তার আগে ও পরে আরও অনেক বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকের নিরলস প্রচেষ্টা এবং গবেষণা এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে সম্ভব করে তুলেছে।

প্রাথমিক ধারণা ও প্রথম প্রচেষ্টা

বৈদ্যুতিক আলোর ধারণা ১৮০০-এর দশকের শুরু থেকেই বিজ্ঞানীদের মনে ছিল। ১৮০০ সালে ইতালীয় বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা প্রথম বৈদ্যুতিক ব্যাটারি আবিষ্কার করেন, যা "ভোল্টাইক পাইল" (Voltaic Pile) নামে পরিচিত। এই ব্যাটারি বৈদ্যুতিক প্রবাহের একটি স্থিতিশীল উৎস সরবরাহ করে, যা পরবর্তী আবিষ্কারগুলোর জন্য পথ খুলে দেয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৮০২ সালে ব্রিটিশ রসায়নবিদ হামফ্রি ডেভি (Humphry Davy) প্রথম বৈদ্যুতিক আলো তৈরি করতে সক্ষম হন। তিনি কার্বন দণ্ড ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী আর্ক ল্যাম্প (Arc Lamp) তৈরি করেন, যা উজ্জ্বল কিন্তু অনিয়মিত আলো দিত। এই ল্যাম্পগুলো ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, দ্রুত পুড়ে যেত এবং জ্বলন্ত অবস্থায় কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন করত। তাই এটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত ছিল না।

ফিলামেন্টের খোঁজে: দীর্ঘ এক গবেষণা

আর্ক ল্যাম্পের সীমাবদ্ধতা দূর করতে বিজ্ঞানীরা এমন একটি ডিভাইস তৈরির চেষ্টা করেন, যা কম খরচে, দীর্ঘ সময় ধরে এবং নিরাপদভাবে আলো দিতে পারে। এর মূল চ্যালেঞ্জ ছিল এমন একটি ফিলামেন্ট খুঁজে বের করা, যা বৈদ্যুতিক প্রবাহের কারণে উত্তপ্ত হয়ে সাদা আলো দেবে, কিন্তু সহজে গলে বা পুড়ে যাবে না।

এ সময় বহু বিজ্ঞানী বিভিন্ন ধরনের উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জোসেফ সোয়ান (Joseph Swan)। ১৮৬০ সালে তিনি একটি ভ্যাকুয়াম টিউবের মধ্যে কার্বনাইজড পেপার ফিলামেন্ট ব্যবহার করে একটি কার্যকরী বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করেন। কিন্তু সে সময় ভ্যাকুয়াম পাম্পের প্রযুক্তি উন্নত না হওয়ায় বাতিগুলো বেশিদিন টিকত না। পরে তিনি ভ্যাকুয়াম পাম্পের উন্নতি ঘটান এবং ১৮৭৮ সালে সফলভাবে একটি দীর্ঘস্থায়ী বৈদ্যুতিক বাতি প্রদর্শন করেন। সোয়ান তার বাতির পেটেন্টও নেন এবং যুক্তরাজ্যে তার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেন।

টমাস এডিসনের যুগান্তকারী অবদান

জোসেফ সোয়ানের প্রায় একই সময়ে আমেরিকাতে টমাস এডিসনও বৈদ্যুতিক বাতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এডিসন শুধু একটি বাতি আবিষ্কার করতে চাননি, তিনি একটি সম্পূর্ণ আলোক ব্যবস্থা (Lighting System) তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ এবং ব্যবহার সবকিছুকে একীভূত করবে।

এডিসন তার গবেষণা দল নিয়ে হাজার হাজার উপাদান নিয়ে ফিলামেন্টের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। তিনি প্রথমে কার্বনাইজড তুলা (carbonized cotton), কার্বন ফিলামেন্ট, প্লাটিনাম ও ইরিডিয়ামসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ নিয়ে কাজ করেন। অবশেষে, ১৮৭৯ সালের ২২শে অক্টোবর, তিনি একটি কার্বনাইজড সুতার ফিলামেন্ট (carbonized thread filament) ব্যবহার করে এমন একটি বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করতে সক্ষম হন, যা একটানা ১৩.৫ ঘণ্টা জ্বলেছিল। এটি ছিল এডিসনের একটি বিশাল সাফল্য।

এডিসন এখানেই থামেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, একটি সাধারণ ফিলামেন্ট দিয়ে ব্যাপক বাণিজ্যিক সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি তার গবেষণা চালিয়ে যান এবং জাপানি বাঁশ (carbonized bamboo) ব্যবহার করে এমন একটি ফিলামেন্ট তৈরি করেন, যা ১,২০০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জ্বলতে সক্ষম ছিল। ১৮৮০ সালে তিনি এই ফিলামেন্টের পেটেন্ট নেন এবং তার কোম্পানি "এডিসন ইলেকট্রিক লাইট কোম্পানি" বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে।

এডিসনের আরেকটি বড় সাফল্য ছিল একটি সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা তৈরি করা। ১৮৮২ সালে তিনি নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেন, যা আশেপাশের গ্রাহকদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করত। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং তার আবিষ্কৃত দীর্ঘস্থায়ী বাতি একসঙ্গে মিলে বৈদ্যুতিক আলোকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তোলে।

এডিসন বনাম সোয়ান: একটি আইনি লড়াই

টমাস এডিসন এবং জোসেফ সোয়ান দুজনেই প্রায় একই সময়ে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করায় তাদের মধ্যে পেটেন্ট নিয়ে একটি আইনি লড়াই শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত, তারা দুজনেই তাদের বিরোধ মিটিয়ে ফেলেন এবং ১৮৮৩ সালে তাদের কোম্পানি দুটিকে একীভূত করে "এডিসন-সোয়ান ইউনাইটেড ইলেকট্রিক লাইট কোম্পানি" গঠন করেন, যা যুক্তরাজ্যে বৈদ্যুতিক বাতির বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ শুরু করে।

পরবর্তী উন্নয়ন ও আধুনিক বাতি

এডওয়ার্ডনের মৌলিক আবিষ্কারের পর বৈদ্যুতিক বাতির প্রযুক্তিতে আরও অনেক উন্নতি হয়েছে।

  • উইলিস হুইটনি (Willis Whitney): ১৯০৩ সালে তিনি এমন একটি প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে কার্বন ফিলামেন্টকে উত্তপ্ত করে তার স্থায়িত্ব বাড়ানো হয়।

  • উইলিয়াম কুলিডজ (William Coolidge): ১৯১০ সালে তিনি টাংস্টেন ফিলামেন্টের বাণিজ্যিক উৎপাদনে সক্ষম হন। টাংস্টেন একটি শক্তিশালী এবং উচ্চ গলনাঙ্কবিশিষ্ট ধাতু, যা বর্তমানেও ইনক্যান্ডেসেন্ট বাতির ফিলামেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এরপর ফ্লুরোসেন্ট বাতি, এলইডি (LED) বাতি, সিএফএল (CFL) বাতির মতো আরও অনেক আধুনিক ও শক্তি সাশ্রয়ী প্রযুক্তির আবির্ভাব হয়েছে, যা আমাদের পৃথিবীকে আরও বেশি আলোকিত করে তুলেছে।

উপসংহার

বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের ইতিহাস তাই একজন একক আবিষ্কারকের গল্প নয়, বরং এটি ডেভি, সোয়ান এবং এডিসনের মতো অসংখ্য বিজ্ঞানীর সম্মিলিত মেধা, পরিশ্রম ও উদ্ভাবনী চেতনার ফল। এডিসন হয়তো প্রথম বাতি আবিষ্কার করেননি, কিন্তু তিনি এমন একটি কার্যকরী এবং দীর্ঘস্থায়ী বাতি তৈরি করেন এবং তার বাণিজ্যিক বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে আলোর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন, যা পৃথিবীকে চিরতরে পরিবর্তন করে দেয়।

কোন মন্তব্য নেই

5ugarless থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.